একসময় বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে জন্ম নেয় রাফি নামের একটি ছেলে। তার জন্মই যেন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করার জন্য। বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই, মা দিনমজুরের কাজ করে কোনোমতে সংসার চালান। সংসারের অবস্থা এমনই ছিলো যে, প্রতিদিন ভরপেট খেতে পাওয়া যেন এক ধরনের স্বপ্ন ছিলো রাফির পরিবারের কাছে।
কিন্তু রাফি ছিলো অন্যরকম। দারিদ্র্য তাকে ভাঙতে পারেনি। তার চোখে সবসময় ছিলো এক অদ্ভুত স্বপ্নের আলো। সে চাইতো একদিন বড় হয়ে শহরে পড়াশোনা করবে, বড় চাকরি করবে আর তার মায়ের দুঃখ ঘুচাবে।
—
শিশুকাল ও সংগ্রাম
রাফি ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভীষণ আগ্রহী ছিলো। স্কুলে যাওয়ার জন্য সে ভোরবেলা মাঠে গরু চরাতো, কাজ শেষ করে স্কুলে ছুটে যেত। তার ছেঁড়া জামা, পুরোনো ব্যাগ, আর খালি পায়ে স্কুলে যাওয়া দেখে বন্ধুরা হাসাহাসি করত। তবুও রাফি কষ্ট পেত না। সে বিশ্বাস করতো—
“আজ আমি গরিব, কিন্তু একদিন আমার জ্ঞানই হবে আমার আসল শক্তি।”
কিন্তু অভাব তাকে পড়াশোনা থেকে টেনে সরিয়ে নিল। পরিবারের খরচ চালাতে ক্লাস সেভেন পড়ার সময় থেকেই তাকে অন্যের জমিতে কাজ করতে হলো। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রোদে পুড়ে সে কাজ করত, আর রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে মায়ের পাশে বসে পুরোনো বইগুলো পড়তো।
—
মায়ের উৎসাহ
রাফির মা ছিলেন তার সবচেয়ে বড় শক্তি। প্রতিদিন রাতে ছেলে যখন পড়াশোনা করত, মা চুপচাপ তাকিয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে বলতেন—
“ছেলে আমার, তুই হাল ছাড়িস না। একদিন তোর স্বপ্ন পূরণ হবেই।”
এই কথাগুলোই রাফির কাছে আশার প্রদীপ হয়ে উঠেছিল। যতই কষ্ট আসুক, সে আবার উঠে দাঁড়াত।
—
গ্রামের মানুষের তিরস্কার
কিন্তু সমাজ সবসময় সহজ হয় না। গ্রামের অনেকেই বলত—
“এত পড়াশোনা করে কি হবে? কৃষকের ছেলে কৃষকই থাকবে।”
কেউ কেউ আবার হাসত—
“রাফি শহরে গিয়ে পড়াশোনা করবে! ওর কি সেই সামর্থ্য আছে?”
এসব কথা রাফির মনে কষ্ট দিত, কিন্তু সে কখনো থেমে যায়নি। বরং ভেতরে ভেতরে তার জেদ আরও বেড়ে যেত।
—
টাকার জন্য সংগ্রাম
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে রাফি তার শ্রমের টাকাগুলো অল্প অল্প করে জমাতে লাগল। কষ্টে জমানো সেই টাকায় সে একদিন শহরে গিয়ে ভর্তি হলো একটি কলেজে।
প্রথম প্রথম শহরের পরিবেশ তার কাছে খুব অচেনা লাগত। অনেক সময় ক্ষুধার্ত অবস্থায় ক্লাস করত, কখনো রাত জেগে টিউশন পড়িয়ে টাকার ব্যবস্থা করত। কিন্তু তার মনোবল ছিল অটল।
—
দীর্ঘ লড়াইয়ের ফল
অবশেষে কয়েক বছরের নিরলস চেষ্টা, পড়াশোনা আর আত্মত্যাগের পর রাফি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সক্ষম হলো। সেখানে থেকেও তাকে অদম্য পরিশ্রম করতে হলো। শেষমেশ তার স্বপ্ন পূর্ণ হলো—সে একটি বড় সরকারি চাকরিতে যোগ দিল।
মা চোখ ভেজা হাসি নিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন—
“আমি তোকে বলেছিলাম রাফি, স্বপ্ন কখনো হারায় না, যদি তুই মন থেকে আঁকড়ে ধরিস।”
—
গ্রামে ফেরা
চাকরি পাওয়ার পর রাফি একদিন গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেল। যাঁরা একসময় তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিল, তাঁরা অবাক হয়ে দেখল—যে ছেলেটাকে তারা তুচ্ছ করেছিল, সেই ছেলেই আজ গ্রামের গর্ব।
সে গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করল, যাতে অন্য কোনো শিশু তার মতো কষ্ট না পায়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সে গ্রামবাসীকে বোঝাতে লাগল—
“শিক্ষাই হলো জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। দারিদ্র্য কোনো বাধা নয়, যদি তোমার মধ্যে স্বপ্ন থাকে।”
—
গল্পের শিক্ষা
এই গল্প আমাদের শিখিয়ে যায় যে—
1. দারিদ্র্য বা কষ্ট কোনোদিনই প্রকৃত স্বপ্নবাজকে থামাতে পারে না।
2. যদি মনের ভেতরে জেদ আর পরিশ্রম থাকে, তবে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।
3. সমাজের কথায় ভেঙে না পড়ে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে।
4. মায়ের দোয়া আর অনুপ্রেরণা মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় শক্তি।
—
✨ শেষ কথা:
“হারানো স্বপ্ন” আসলে হারায় না, যদি তুমি সেটাকে আঁকড়ে ধরতে জানো। জীবন যত কঠিনই হোক, স্বপ্ন পূরণের আনন্দের কাছে সেই কষ্টগুলোই হয়ে ওঠে মধুর স্মৃতি।